অশ্বগন্ধা কী?
আপনি যদি আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করে থাকেন বা বিকল্প চিকিৎসায় বিশ্বাসী হন, তাহলে বহুবার অশ্বগন্ধার নাম শোনার সম্ভাবনা আছে। আর কেনই বা নয়? অশ্বগন্ধা হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আয়ুর্বেদী ভেষজ। অথর্ববেদ অনুসারে, হাজার হাজর বছর ধরে অশ্বগন্ধার উপস্থিতি এবং ব্যবহার লক্ষ করা যায়। ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে এটিকে ‘‘অত্যাশ্চর্য ভেষজ’’ বা অ্যাডাপ্টোজেন (মানসিক চাপ মুক্তির এজেন্ট) বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে কারণ মানসিক চাপের উপসর্গ বা দুশ্চিন্তার উপসর্গ কমাতে সাধারণ ভেষজের মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যবহৃত হয়।
অশ্বগন্ধা নামটি এসেছে অশ্ব বা ঘোড়া এবং গন্ধা বা গন্ধ থেকে। তাছাড়া মূলত এই নামটি এসেছে অশ্বগন্ধার মূল বা শিকড় থেকে, যা থেকে ঘোড়ার প্রস্রাব বা ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। অতিরিক্তভাবে আয়ুর্বেদ গবেষকেরা বিশ্বাস করেন, অশ্বগন্ধা গ্রহণ করলে ঘোড়ার মত শক্তি (শারীরিক শক্তি এবং যৌনক্ষমতা) অর্জন করা যায়।
অশ্বগন্ধার কিছু প্রাথমিক তথ্য:
বৈজ্ঞানিক নাম: উইথানিয়া সমনিফেরা
পরিবার: সোলানিসিয়াইওই (নাইটশেড ফ্যামিলি)
সংস্কৃত নাম: অশ্বগন্ধা, বরাহকর্নী (পাতা দেখতে শূকরের কানের মত), কামারূপিনি
সাধারণ নাম: উইন্টার চেরি, ইন্ডিয়ান জিনসেন, পয়জন গুজবেরি
যে অংশ ব্যবহৃত হয়: মূলত মূল বা শিকড় এবং পাতা, তবে ফুল এবং বীজও ব্যবহার হয়।
যেখানে উদ্ভূত এবং ভৌগৌলিক বণ্টন: অশ্বগন্ধা ভারতের অধিকাংশ ঊষ্ণ এলাকায় (মূলত মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থান), নেপাল, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য, তবে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছে গিয়েছে।
অশ্বগন্ধা একাধিক ‘পদ্ধতিতে’ কাজ করে। ভেষজশাস্ত্রে পদ্ধতি বলতে বোঝানো হয়, কী করে একটি ভেষজ বা উদ্ভিদ শরীরের ওপর কাজ করে। শরীরের সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি ভেষজের নির্দিষ্ট পদ্ধতিগুলিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। ভেষজ হিসাবে অশ্বগন্ধার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ব্যবহারগুলি নিচের তালিকায় দেওয়া হল:
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে ব্যবহার হয় বলে এটিকে অ্যাডাপ্টোজেন বলা হয়।
শরীরকে চাঙা করে এবং শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
সাম্প্রতিক কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে জানা গিয়েছে, অশ্বগন্ধার মধ্যে কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই ভেষজের সম্ভাব্য ব্যবহার জানতে গবেষণার কাজ এখনও চলছে।
একটি গবেষণার পর সংশ্লিষ্ট ভারতীয় বৈজ্ঞানিকেরা দাবি করেছেন, সন্ধিস্থলের ব্যাথা, বিশেষত যাঁরা রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসে আক্রান্ত, কমাতে এটি কার্যকরী।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে অশ্বগন্ধা জীবনীশক্তি এবং যৌনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
মূত্রবর্ধক (ডাইরেটিক)হওয়ায় শরীর থেকে অতিরিক্ত তরল এবং লবণ বার করতে সাহায্য করে।
শরীর পরিষ্কার রাখা এবং অকল বার্ধক্যের উপসর্গ প্রতিরোধ করে।
একটি সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, পুরুষের শুক্রাণূবৃদ্ধি ঘটায়।
শক্তিবর্ধক হিসাবে অশ্বগন্ধা শরীর উষ্ণ রাখে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয় এটি পিত্ত বৃদ্ধি ঘটায়।
সুতরাং পিত্ত কাকে বলে?
🔰🔰আয়ুর্বেদ-এ তিনটি ‘‘দোষ’’- বা শরীরে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রকের এর কথা বলা হয়েছে ব্যক্তির সুস্বাস্থ্যের জন্য যেগুলির মধ্যে সমতা থাকা জরুরি। এগুলি হল:
বাত- শরীরের গতিবিধি এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
পিত্ত- শরীরের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংযুক্ত।
কফ- শরীরের ফ্লুইড ব্যালেন্স বা জলীয় পদার্থের সমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
স্বাস্থ্যের উপকারিতা এবং অশ্বগন্ধার ব্যবহার - Health Benefits and Uses of Ashwagandha in Bengali
মানসিক চাপ কম করে বলে খ্যাতি থাকলেও অশ্বগন্ধার বিভিন্ন ধরনের কার্যকারিতা আছে। স্বাস্থ্যোন্নয়নে এই ভেষজ উদ্ভিদ কী কাজ করে একবার দেখে নেওয়া যাক।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়: অশ্বগন্ধা একটি নামকরা অ্যাডাপ্টোজেন। দেখা গিয়েছে, এটি মানসিক চাপ, অবসাদ এবং দুশ্চিন্তা কমায় এবং মানসিক চাপ সংক্রান্ত সমস্যা যেমন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়বিটিস প্রতিরোধ করে।
ডায়বিটিস নিয়ন্ত্রণ করে: গবেষণাপত্রে প্রকাশ পেয়েছে, অশ্বগন্ধা উন্নতমানের ডায়বিটিস প্রতিরোধী (অ্যান্টি-ডায়বিটিস)।এটি স্বাস্থ্যবান এবং ডায়বিটিস আক্রান্তদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
আর্থারাইটিসের উপসর্গ কম করে: কার্যকর প্রদাহ-বিরোধী হওয়ায় অশ্বগন্ধা আর্থারাইটিসের ব্যাথা এবং ফোলা কমায়। পিত্ত, আয়ুর্বেবেদিক চিকিৎসাশাস্ত্রে যাকে আর্থারাইটিসের কারণ বলে ধরা হয়, তার সমতা নিয়ে আসে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: গবেষণায় প্রকাশিত যে অশ্বগন্ধা হচ্ছে অসাধারণ ইমিউনোস্টিমুলেটর (রোগ প্রতিরোধী)। সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধী শক্তি বাড়িয়ে তোলে।
ক্ষত নিরাময়ে অনুঘটক: ক্ষত নিরাময় দ্রুত হওয়ার জন্য প্রাথমিক স্তরে অশ্বগন্ধা খাওয়ানোর সুপারিশ করা হয়। তবে এই গুণের নিশ্চিত প্রমাণের জন্য আরও মানুষের ওপর প্রয়োগের সমীক্ষার প্রয়োজন আছে।
নিদ্রা গাঢ় করে: চাপ এবং দুশ্চিন্তা কমিয়ে অশ্বগন্ধা মাথা ঠান্ডা করতে সাহায্য করে বলে ঘুম খুব ভাল হয়।
যৌনক্ষমতা বাড়ায়: অশ্বগন্ধা পুরুষ এবং নারীদের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মানসিক সমস্যার দরুণ পুরুষদের লিঙ্গ উচ্ছৃত হওয়ার সমস্যা দূর করতে এবং শুক্রাণু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
থাইরয়েড প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করে: দেখা গিয়েছে অশ্বগন্ধা শরীরে T4 মাত্রা বৃদ্ধি করতে এবং হাইপোথাইরয়েডিজম কমাতে সাহায্য করে। তবে, মানব শরীরে ব্যবহার নিরাপদ কিনা তা জানতে আরও পরীক্ষার প্রয়োজন আছে।
হৃদযন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: অশ্বগন্ধা হৃদয়ের পেশি শক্তিশালী করে হৃদযন্ত্রের সামগ্রিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যার ফলে রক্ত জমাট হয় না এবং হৃদয় ( হার্ট) এর ওপর চাপ কমে। হৃদরোগের অন্যতম ঝুঁকি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করে: সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে অশ্বগন্ধা পার্কিনসন ও অ্যালজাইমারের দরুণ স্নায়বিক ক্ষতির হার কমিয়ে দেয়। তবে এর কার্যকারণ এখনও জানা যায়নি।
অ্যাড্রিনাল ফেটিগ প্রতিরোধ করে: এটি যেহেতু একটি অ্যাডাপ্টোজেনিক ভেষজ, অশ্বগন্ধা মন শান্ত করে, যা আবার শরীরে কর্টিসল মাত্রা (স্ট্রেস হরমোন) কমায়। সেটি আবার বৃক্কের ওপর চাপ কমায় বলে অ্যাড্রিনাল ফেটিগ (অড্রিনাল ক্ষরণজনিত ক্লান্তি) হ্রাস পায়।
সাপের বিষনাশক (অ্যান্টি-ভেনম) হিসাবে কার্যকলাপ: সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, সাপের কামড়ের জায়গায় অশ্বগন্ধার প্রলেপ সাপের বিষ প্রশমিত হয় এবং শরীরের অন্যত্র তা ছড়ায় না। স্বাভাবিকভাবে এটি চিরাচরিতভাবে সাপের বিষনাশক হিসাবে প্রচলিত।
ত্বকের জন্য উপকারী: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস হওয়ার দরুণ অশ্বগন্ধা একটি প্রকৃত বার্ধক্য প্রতিরোধী ভেষজ। বয়ঃবৃদ্ধির প্রাথমিক উপসর্গ রোধ করে এবং শুষ্ক ত্বক এবং কেরাটোসিস-এর বিরুদ্ধে শরীর রক্ষা করে।
চমৎকার কেশ টনিক: অশ্বগন্ধা চুলে পুষ্টি জোগায়, যা চুল পড়া কমতে সাহায্য করে এবং চুল দীর্ঘ এবং উজ্জ্বল করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়ার কারণে অকালে চুলে পাক ধরা এবং চুল পড়া বন্ধ হয়।
রজঃস্রাবের উপসর্গ হ্রাস করে: টনিক এবং অশ্বগন্ধার মানসিক চাপ প্রতিরোধী ক্ষমতা এটিকে মহিলাদের ঋতুচক্র চলাকালীন সময় চমৎকার কাজ দেয়। এটি চাপ, দুশ্চিন্তা কমায়, হরমোন নির্যাসে সমতা নিয়ে আসে, রজঃস্রাবের উপসর্গ হ্রাস করে।
পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে: সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অশ্বগন্ধা পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি শুধুমাত্র শুক্রাণু সংখ্যা এবং টেস্টোস্টেরোন বৃদ্ধি করে না, এটি যৌনক্ষমতা এবং ক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অশ্বগন্ধা - Ashwagandha for mental health in Bengali
অশ্বগন্ধার বহু উপকারিতা এবং ব্যবহার আছে তবে এটি প্রাথমিকভাবে মানসিক চাপ প্রতিরোধী থেরাপির জন্য ব্যবহৃত হয়।
এর দুশ্চিন্তা নিরোধক উপাদানের সঙ্গে চিন এবং সাইবেরিয়ার জিনসেন-এর তুলনা করা হয়। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অশ্বগন্ধার ব্যবহারে দুশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপের কারণে উদ্ভূত অবসাদ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে। এর অ্যাড্যাপ্টোজেনিক এবং পুষ্টিবর্ধক ক্ষমতার জন্য বিশেষভাবে তা সম্ভব হয়। বলতে হয়, এর অ্যাড্যাপ্টোজেনিক গুণ বহু মানসিক চাপ সম্পর্কিত রোগ, যেমন অকাল বার্ধক্য, উচ্চ রক্তচাপ (হাইপারটেনশন) এবং ডায়বিটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে।
ডায়বিটিসের জন্য অশ্বগন্ধা - Ashwagandha for diabetes in Bengali
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যাঁদের ডায়বিটিস আছে সে সব রোগীর ক্ষেত্রে শরীরে ইনসুলিন ক্ষরণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়।


0 Reviews:
Post Your Review